কবিতার দ্বীন-ই-ইলাহি কিম্বা ভারতমাতার নয়া প্রস্তাব

প্রথমে পশ্চিমবাংলার একজন বাঙালী কবির লেখা থিকা উদ্ধৃতি দিছি। পরে আমি দেখাইতে চেষ্টা করছি কেন ইন্ডিয়ায় বিজেপির পলিটিক্সের প্রতি নিরব থাইকা ব্রিটিশ উপনিবেশের আগের যে “হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি” সেইটা ফিরাইয়া আনার প্রস্তাব আসলে প্রতিক্রিয়াশীল প্রস্তাব। – লেখক


“বাংলার কাঁসার তনুভায়, শীতলাতলার ঝুপসি সাঁঝে, রমজানের শুদ্ধাচারে, মানিক পিরের চেরাগের ধোঁয়ায়, লক্ষ্মীডুবি দিঘির গহনে, মহালয়াকালীন তর্পণক্রিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছে বহুমাত্রিক সময়, যেখানে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেনি। কবিতা কেন প্রবেশ করবে না সেখানে? কেন খুঁজবে না বদর শেখের নাম নিয়ে কূল ছেড়ে চলে যাওয়া নৌকার গতিপথ অথবা মাতৃমূর্তির সামনে বসে শ্যামাসঙ্গীতের রচয়িতা সাধকের নন্দনকে, কেন জানবে না বাঙালির গেরস্থালির সমগ্রকে? খোঁজ ঐখানেই। ঐখানেই লুকিয়ে আছে উত্তর-ঔপনিবেশিক ‘আধুনিক’ দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠেকানোর শক্তি। তার সন্ধান করুক কবিতা। এ কামনা কোনো জোর খাটানো নয়। এ কামনা হৈমন্তিক রাস উৎসবের মত ফুরফুরে, মলমাস কেটে গিয়ে উৎসব সম্ভাবনার মতো আনন্দময়। রমজানের গভীর কৃচ্ছ্রের পর ঈদের চন্দ্রালোকের সামনে দাঁড়ালে যেমন মহাজগতের বোধ জেগে ওঠে, তেমনই দাঁড়াক বাংলা কবিতা একবার সেই সমগ্রের সামনে। নীলাম্বরী শাড়ির নীল কী দিয়ে তৈরি হতো বাঙালি ভুলে গেছে। তাকে জানতে হবে সেইসব উপকরণ, যা থেকে তৈরি হয় সেই কিংবদন্তীর নীল। বাংলা কবিতা আবার বুনুক সেই নীলাম্বরী। কল্যাণ হোক। কল্যাণ হোক।”

— অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, ২০০৭
‘উত্তর ঔপনিবেশিক বাংলা কবিতা’

* * *

১.
‘যদি উপনিবেশের বাইরে ভাষা খুঁজতে হয় তাইলে অতীতে যাইতে হবে।’—এই চিন্তাটা সমকালীন ভারতের পশ্চিমবাংলার কবিদের নতুন প্রকল্প। ঠিক অতীতও নয়, উপনিবেশপূর্ব অতীত। এবং অন্য কোথাও না, অতি অবশ্যই ‘উপনিবেশপূর্ব অতীত’-এ খুঁজতে হবে।

উত্তর-উপনিবেশী অবস্থা থিকা পলায়ন কইরা ওনারা সাংস্কৃতিক নয়া উপনিবেশ তৈরি করতে চান যেইটা ভারতের উপনিবেশপূর্ব হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির অলীক রূপকল্পে গ্রথিত হবে।

কবিতার মধ্য দিয়া সারতে চাইলেও এইটা ভারতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপির রাজনীতিক প্রকল্পের অংশ।

বিজেপি কি উপনিবেশপূর্ব ভারত চায় না?

বিজেপি চায়।

বিজেপি কি মুসলমানপূর্ব ভারত চায় না।

অতি অবশ্যই চায়।

এই কবিরা বিজেপির পথেই আছেন। তারা বিজেপির ইসলামপূর্ব ভারত প্রকল্প নিয়া সোচ্চার অবস্থানে নাই।

ফলে, বাঙলাভাষী কবিদের প্রতি ভারতের সাংস্কৃতিক উপনিবেশের এক নয়া প্রস্তাব এইটা। কবিতার মুক্তির নাম নিয়া হাজির আছে এই প্রস্তাবনা।

২.
বিজেপি চায় “ব্রিটিশ উপনিবেশ ও মুসলমান আগমনের আগের ভারত”রে তুইলা আনতে।

এই কবিরা চাইতেছেন ব্রিটিশ উপনিবেশপূর্ব ভারতে গিয়া থামতে। যেইখানে হিন্দুর আর মুসলমানের সুন্দর সুন্দর অতীত ঘুইরা বেড়াইতেছে। যেন হিন্দুর অতীত হিন্দু রোমন্থন করলে আর মুসলমানের অতীত মুসলমানে রোমন্থন করলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভর করবে উপনিবেশ উত্তর মহা-ভারতে।

আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহি পন্থায় কবিরা একটা “উপনিবেশপূর্ব ভারতমাতা” তৈরি করতে চাইতেছেন। রবীন্দ্রনাথীয় মহা এক ভারত যা পাকিস্তান ও বাঙলাদেশরে হারায় ফেলছে রাজনৈতিক মানচিত্রে, তারে আবার সাংস্কৃতিক ভাবে পুনর্গঠিত করতে চাইতেছে ভারতমানস—তারই ছায়া পড়ছে ভারতের বাঙলাভাষী কবিদের মনে।

যেন, সব আবার ঠিক হইয়া যাবে!

দেখবেন, ভারতের এই বাঙলাভাষী কবিরা সাংস্কৃতিক মহাভারতের স্বপ্নে বিভোর অবস্থায় যতটা “মুসলমান” “মুসলমান” করে ততটা বাংলাদেশের মুসলমানদের সীমান্ত-মৃত্যুতে গা করে না। (বা হিন্দুদের মৃত্যুতে। হিন্দুদের মৃত্যুতে আপত্তি করলে পরে যদি আবার মুসলমানদের মৃত্যুতে আপত্তি করতে হয়!) শুনছেন, ওনারা একটা প্রতিবাদও করছেন কলকাতার রাস্তায়, বাংলাদেশের মানুষদের যে “পাখিহত্যা” করা হয় সীমান্তে, তা নিয়া?

কেবল কবিতা বইলা কিছু নাই বইলাই উপনিবেশ প্রভাবিত কবিতার বাইরে যাইতে চাইতেছেন ওনারা।

অথচ কেবল কবিতার জন্যেই নাকি তাদের সেই যাওয়া!

৩.
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙলা ভাষাটি ইউরোপ প্রভাবিত, কাজেই মধ্যবিত্তের কবিতাও ইউরোপ প্রভাবিত হইতে পারে। এতে দোষ নাই।

উপনিবেশ-পূর্ব অতীতরে কবিতায় জাগাইয়া ইউরোপ কাটানো যাবে না। প্রাত্যহিক ভাষার ক্ষেত্রে ইউরোপের প্রকল্প বহন কইরা কবিতার ক্ষেত্রে “উপনিবেশপূর্ব আইটেম” ব্যবহারের মাধ্যমে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ইউটোপিয়ান।

ইউরোপের দোষ কাটাইতে উপনিবেশপূর্ব ভারতীয় আইটেমের সন্ধান ইউরোপ-প্রভাবিত বাঙলারে বড়জোর আরবি বা ফারসি প্রভাবিত বাঙলার দিকে নিয়া যাইতে পারে। তাতে যদি কবিতা বঙ্গীয় হইয়া ওঠে তবে ইউরোপীয় প্রভাব থাকলেও বঙ্গে কবিতা বঙ্গীয়ই থাকবে।

নিখাঁদ বঙ্গ খোঁজার চর্চা বিশুদ্ধতাবাদীদের নির্মল হাহাকার। ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তার বাস্তবায়ন।

বয়াতি, বাউল, ফকিরদের গানের ভাষার গঠন বিচার কইরা দেখা যাইতে পারে, কেবল বঙ্গ ওইখানেও নাই। এমনকি পরিমাণ মতো ইউরোপ তাদের মধ্যে পাওয়াই যাবে।

উপনিবেশের হাত থিকা গরিবেরা সব বাঁইচা গেছিল নাকি! তাদের জীবন-যাপনে ইউরোপীয় আরাম-আয়েশ হয়তো ঢুকতে পারে নাই, বিধি-নিষেধের মাধ্যমে ইউরোপ ঠিকই তাদের নিয়ন্ত্রণ কইরা গেছে। উপনিবেশ চইলা যাওয়ায় তাদের জীবন থিকা সকল অবশেষ নিশ্চিহ্ন হইয়া গেছে গা বলা যাবে না।

যদি প্রভাবই কবিতার পরিচয় আর প্রকল্প হয় তবে নজরুল ও ফররুখ আহমদ প্রমুখের কবিতারে বলতে হয় আপাদমস্তক মধ্যপ্রাচ্যীয় প্রকল্প। এমনকি ফরহাদ মজহারের ‘এবাদতনামা’ও (১৯৯০) সেই গুণে গুণান্বিত হবে। কিন্তু আমরা জানি, এগুলি সবই বাঙলা কবিতা।

নজরুলের আরবি-ফারসি প্রভাবিত কবিতা যে কারণে বাঙলা কবিতা, ফরহাদ মজহারের ‘এবাদতনামা’র কবিতাও সে কারণে বাঙলা কবিতা। এবং ইউরোপ-প্রভাবিত বাঙলা কবিতাও বাঙলা কবিতাই। ইউরোপ প্রভাবিত বাঙলা ভাষা যেমন বাঙলা ভাষাই।

উপনিবেশপূর্ব ভারত নিয়া কিংবা আরম্ভের সময়ের ইসলাম নিয়া রোমান্টিসিজম কি নস্টালজিয়া কারো থাকলে কবিতায় তা ভুরি ভুরিই আসতে পারে। কিন্তু সবাইকে একাসনে উপনিবেশপূর্ব দেখতে চাওয়াটা ভারতমাতার সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী প্রকল্প।

যা অতীতের নামে, মুসলমানদের গ্রহণের নামে, ভবিষ্যৎরে উপনিবেশিত করার জন্য কবিদের মধ্য দিয়া বন্ধুত্বের হাতসহ আগাইতেছে।

১০/১/২০১৩

6 Comments

Add Yours →

Leave a Reply